কিছু কথিত বুদ্ধিজীবী, অবশ্য তাদেরকে টকশোজীবী বলাই বেশি শ্রেয়, বিভিন্ন টকশোতে গিয়ে ঢালাওভাবে বলে থাকেন সরকারি কলেজ শিক্ষকরা দুপুর বারোটার পর কলেজে থাকেন না। কেউ কেউ আরও বাড়িয়ে বলেন, ওনারা সপ্তাহে দুদিন আসেন, পাঁচদিন ঘুমান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ক্যাডার শিক্ষক কর্মকর্তাদের মাস শেষে বেতন উত্তোলন করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। আহ, কী আরাম শিক্ষকদের!
অথচ, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়া, ভিত্তিহীন, অজ্ঞতাপ্রসূত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জনসাধারণের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু বুদ্ধিজীবী (?) এসব অভিযোগ করে থাকেন। বিবেকের দায়বোধ থেকে এসব অভিযোগ খণ্ডনের জন্য কলম ধরলাম।
বেশিরভাগ সরকারি কলেজ বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। অনেকে কলেজে বারো থেকে ষোলোটি বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স পড়ানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক না দেয়া সত্ত্বেও, বিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ সেখানে স্বেচ্ছায় ক্লাস নিয়ে থাকেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বছরজুড়ে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। কাজ চলে ভর্তি ও ফরম পূরণের। তাদের পরীক্ষার নিয়মিত রুটিন হলো- দুপুর ২.০০টা থেকে বিকেল ৫.০০টা পর্যন্ত। এছাড়াও বিজ্ঞান বিভাগের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসগুলো সাধারণত বিকেলে হয়ে থাকে।
অভ্যন্তরীণ সকল পরীক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস-কোর্স, অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার সকল খাতা গভীর রাত জেগে মূল্যায়ন করে থাকেন সরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দ।
একটি ক্লাস নিতে যদিও বাহ্যত এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে, সেই একটি মানসম্মত ক্লাস তৈরির জন্য একজন প্রাজ্ঞ শিক্ষককে ক্লাসের বাইরে খাটতে হয় বেশ কয়েক ঘণ্টা। গভীর রাতেও। যেমন, লেসন প্লান করা, ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করা, ক্লাস টেস্ট নেয়ার জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি করা, সাজেশন তৈরি করা ইত্যাদি।
ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের তকমা পড়ানো থাকলেও, কার্যত শিক্ষকরা কোনো ছুটিই ভোগ করতে পারেন না। মাঝেমাঝে শুক্রবারেও বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা কিংবা চাকরি পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়।
গ্রীষ্মকালীন অবকাশে উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা পরিচালনা করতে হয়। শীতকালীন অবকাশে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা রমযান মাসজুড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেশনের, বিভিন্ন বর্ষের নানা পরীক্ষা লেগে থাকে।
এছাড়াও বিজ্ঞ ক্যাডার শিক্ষকগণ বছরে বায়ান্নটি শনিবার বেশি শ্রম দেন। এজন্য বাড়তি সম্মানী তারা কখনো পান না। যেখানে প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য সকল কর্মচারী সপ্তাহে দুদিন ছুটি পান, সেখানে শিক্ষকসম্প্রদায় ছুটি পায় মাত্র একদিন।
এছাড়াও সকল জাতীয়দিবসে শিক্ষকদের স্বস্ব কলেজে উপস্থিত থেকে দিবসটি উদযাপন করতে হয়। এমনকি দিবসটি শুক্রবারে হলেও।
যেকোনো জাতীয় নির্বাচনকালে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয় ক্যাডার শিক্ষক কর্মকর্তাদের। ইতোমধ্যে দায়িত্ব পালনকালে অনেকে পটল তুলেছেন। সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়।
সম্ভবত বুদ্ধিজীবী কিংবা টকশোজীবীরা তাঁদের এলাকার বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের কলেজে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি মুদি-দোকান, ওষুধের ফার্মেসি, হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিস, বইয়ের দোকান, রাজনীতি- ইত্যাদি করে দেখতে অভ্যস্ত। তাঁদের সাথে সরকারি কলেজের ক্যাডার শিক্ষকদের গুলিয়ে ফেলেছেন। মনে রাখতে হবে- তেল ও জল এক নয়।
"শিক্ষকতা পেশা আরামের। এখানে কোনো কাজ নেই।" এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ করে মূলত ক্যাডার শিক্ষকদের চলমান ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ও দাবিসমূহকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এক সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য রয়েছে। চক্রান্তও বটে।
ওয়াদুদ খান
প্রভাষক, ইংরেজি
সদরপুর সরকারি কলেজ, ফরিদপুর
০১৭৮৫-৫৬২০৮০