হয় তো বিলাসী জীবন ছিল না ওর। কিন্তু, মনে বড় সুখ ছিল। চোখে জল ছিল না সত্যি। একটি মাত্র ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে ভীষণ সুখী ছিল সে।
ওর স্বামী একাব্বর অন্যের জমিতে কিষাণি দিত। বাড়িতে গরু ছিল, ছাগল ছিল, হাঁস ছিল, মুরগি ছিল। বাড়ির সামনের ছোট্ট পুকুরটাতে মাছও ছিল। এই তো দূরে দেখা যাওয়া বহতা যমুনার মতো জীবনটাও ওদের বয়ে যাচ্ছিল ছলাৎ ছলাৎ করে।
অশিক্ষিত ওরা।
দেশের কিংবা বিদেশের খোঁজ ওরা রাখে না। রাখবার সময়ও ওদের নেই। কিন্তু, একাব্বর কার কাছে যেন শুনে এসেছে- উজান থেকে পানি আসছে। যে পানির জন্য শুকনো মৌসুমে একাব্বরের মতো কৃষকেরা চাতকের মতো থেকেছে অপেক্ষায়, সেই পানি আসবে শুনে- কেমন জানি শরীরটা শীতল হয়ে আসে। ভয় ধরে যায়!
ওদের বাড়ি যমুনার কাছাকাছি এক চরে। যমুনার ভাঙনের শিকার হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। ওদের মতো আরও অনেকেই। দেখতে দেখতে একটা সমাজ গড়ে ওঠেছে। কে বলবে- বছর দশেক আগে এখানে জনমানবের কোনো চিহ্ন ছিল না।
সেদিন রাতে আমেনাকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল একাব্বর, “এইবার মাঠের সব ধান ভাইসা গেছে। মনে অইতাছে- ঘরবাড়ি সব ভাসাইয়া নিয়া যাইব। পানির বাড় খুব বেশি।“
কয়েকদিনের মধ্যে পানি উঠোনে চলে আসে। গরু-ছাগলের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না আর। হাস-মুরগি ঘরের এক কোণে আশ্রয় পায়। আজিমুদ্দিনের নৌকায় বাজারে নিয়ে গিয়ে পালের দুটি গরু, একটি বাছুর, আর চারটি ছাগল পানির দামে বেঁচে দিয়ে আসে। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।
এইসব চরাঞ্চল যেন দেশের ভেতরে আরেক খন্ড দেশ। এখানে বিদ্যুত আসেনি। ফেসবুক নেই। কোনো পেপার আসে না। এই যে এত কিছু ঘটে চলেছে, কোনো সাংবাদিক এ এলাকায় আসেনি। ত্রানের লোকজনকেও দেখা যায়নি এ এলাকাটায়। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা যেন ওরা।
ধীরে ধীরে খালি হয়ে আসছে পুরো চরাঞ্চল। যে যেখানে পারছে চলে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে গেছে আমেনাদের। আজকে সকালে খবর পেয়েছে- মজনু শেখের পালের তিনটে গাভী বানের জলে ভেসে গেছে। বেচার সুযোগ পায়নি সে। জমির ব্যাপারীদের নৌকাটা ডুবে গিয়ে মারা গেছে পাঁচজন। জমির ব্যাপারীও বেঁচে নেই আর। আহ, কী নির্মম জীবন! কী রুঢ় বাস্তবতা!
চারদিকে কেমন জানি হাহাকার। চাপা কান্নার ধ্বনি পানির স্রোতের মাঝে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পুরো সমাজটা কেমন জানি নিরব। নিস্তব্দ। কোনো মানুষ আর নেই যেন!
চৌকিতেই মাটির চুলায় রান্না হচ্ছে ওদের। একাব্বর বলে, “আমেনা, আইজকের মইধ্যেই আমাগো চইলা যাইতে অইব। আর থাকন যাইবো না। রাইতের মইধ্যে পানি বিছানায় উঠবো।"
বিশাল এই পৃথিবীতে ওদের থাকার জায়গা কি আছে?
ওরা ভাবে- অন্যের বাড়িতে কৃষাণি দিয়ে, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে চলবে- তবুও বাঁচতে হবে, একমাত্র ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া যাবে না।
পানির স্রোতের গতি অস্বাভাবিক। শো শো শব্দ। সাগরের গর্জন ওরা শোনেনি। দেখেওনি। তবে কেন জানি মনে হয়, সাগরের গর্জনও এতটা ভয়ংকর নয়।
পাঁচ বছরের ছেলে লাল চাঁন। ভয়ভীতি ওর নেই। এই যে ঘরের ভেতর পানি ঢুকে গেছে, হাতটা নামিয়ে দিলে পানি ছোঁয়া যায়, এটা ভয় নয়, ওর মধ্যে এক অপার্থিব ভালোলাগা তৈরি করেছে। আমেনার সদা সতর্ক দৃষ্টি ছেলেটার দিকে। এই তো গত সোমবার জমিলার তিন বছরের মেয়েটা মারা গেল। পরীর মতো দেখতে ছিল!
একাব্বর নৌকা আনতে গেছে ঘন্টা তিনেক হলো। ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে আমেনা। এত দেরি হচ্ছে কেন তাঁর?
ঘরের চৌকাঠের সাথে একটা কলা গাছের ভেলা বেঁধে রেখেছে ওরা। লাল চাঁনকে সাথে নিয়ে ভেলায় গিয়ে ওঠে আমেনা। যেদিকে দুচোখ যায়, যতদূর চোখ যায়- থৈ থৈ জল। এ জলের যেন কিনারা নেই। আদিঅন্তহীন। একাব্বরকে কোথাও দেখা যায় না। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসে আমেনার।
হঠাৎ ‘টুপ’ করে একটা শব্দ হয়। লাল চাঁনকে ভেলায় দেখা যাচ্ছে না আর। ‘লাল চাঁন’ বলে জোরে চিৎকার করে ওঠে আমেনা। লাফিয়ে পড়ে পানিতে।
শো শো শব্দ করা স্রোতের মাঝে একা একটা রমনী ‘লাল চাঁন’ ‘লাল চাঁন’ বলে চিৎকার করতে করতে ভেসে যেতে থাকে...
হায় আল্লাহ, আমেনার দুচোখে এত জল ছিল!
সদরপুর, ফরিদপুর
|
কবি ও কথাশিল্পী |