নো বিসিএস, নো ক্যাডার (KNOW BCS, KNOW CADRE)

ফেসবুক খুললেই ইদানীং শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রোফাইলে কিংবা টাইমলাইনে একটি বিশেষ স্লোগান দেখা যায়- যা আমজনতারও নজর কেড়েছে। সেটি হলো- NO BCS, NO CADRE- যার সরলার্থ  'বিসিএস ছাড়া ক্যাডার নয়'।

শিক্ষা ক্যাডার বাদে অপরাপর ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেকে এতদিন জানতেনই না- এই বিচিত্র বঙ্গদেশে বিসিএস পরীক্ষায় না বসেও, নানা ফাঁক ফোকড়ে রাতারাতি ক্যাডার হওয়া যায়।

NO BCS, NO CADRE স্লোগানকে ধারণ করে আমি একটি প্রোফাইল ফ্রেম তৈরি করেছিলাম- যা মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২২০০ কর্মকর্তা তাঁদের প্রোফাইলে সেট করেছিলেন। এমনকি অনেক ছাত্র, দোকানদার, অন্যপেশার লোক, হাইস্কুল ও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকগণও সেটি ব্যবহার করেছিলেন। অনেকেই তখন ইনবক্সে জানতে চাইতো, "আচ্ছা, নো বিসিএস, নো ক্যাডার- কেন লিখেন? এর মানেই বা কী?" তাদেরকে সংক্ষেপে বলতাম, "KNOW BCS, KNOW CADRE. তাহলেই বুঝবেন আমরা কেন গলা ফাটিয়ে রোজ বলছি NO BCS, NO CADRE."

কয়েক বছর আগের ঘটনা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা আনতে শিক্ষাবোর্ডে গিয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছিল নগরকান্দা থানার এক বেসরকারি কলেজ শিক্ষকের সাথে। বাসে চেপে একসাথে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এসেছি। আমাকে সে কি শ্রদ্ধা! সিট কম থাকায় জোর করে আমাকে সিটে বসিয় তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন অনেকক্ষণ। বারবার আফসোস করছিলেন, "জানেন স্যার, বিসিএস ক্যাডার হবার খুব স্বপ্ন ছিল। তিনবার প্রিলিমিনারি দিয়েছি। কিন্তু ভাগ্যের শিকে ছিড়েনি। লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত যেতে পারিনি। আপনাদেরকে দেখলে খুব হিংসে হয়। কত্ত মেধাবী আপনারা!" আমি আন্তরিকভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনাদের কলেজে নিয়োগ কি ফেয়ার হয়েছিল?" তিনি লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, "ফেয়ার! এই দেশে বিসিএসের নিয়োগই একটু ফেয়ার আছে। কলেজের নিয়োগ তো একটা ভাওতাবাজি। এমপি, ম্যানেজিং কমিটি, ডোনেশন- কত কাহিনি।"

তখন আমার মনে একটি স্মৃতি দোলা দিলো। আমি তখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছি। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশও করেছি। আমাকে আমার এক আত্মীয় ফোন করে বলল, "ওয়াদুদ, তোমাকে একটা প্রক্সি দিতে হবে।" 'প্রক্সি' শব্দটা শুনে অবাক হয়েছিলাম। পরে উনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, "হয়েছে কি, একটা কলেজে যোগদানের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকার চুক্তি করেছি। কমপক্ষে তিনজনের আবেদন করতে হয়। আমি আছি, আরেকজনকে রেডি করেছি, আর তুমি হলে তিনজন হয়। সবই স্টেজ ম্যানেজড। পরীক্ষার ফি, খরচ, খাওয়া-দাওয়া- সব আমার।"

সেই যোগদান নাটকের মঞ্চায়ন, দৃশ্যায়ন, নিখুঁত অভিনয়- এখনো মানসপটে ভাসে। 

সেদিন রাতে টাঙ্গাইল পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে বসে লাল চা খাচ্ছিলাম। আমার পরিচিত এক রাজনৈতিক নেতা- আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল, "দশ লাখ টাকা খরচ করে বউকে আপনাদের মতো ক্যাডার বানিয়ে দিলাম।" বিস্তারিত জানতে চাইলে বলল, "তিন বছর আগে দশ লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে বাসাইল মহিলা কলেজে বউকে ঢুকিয়ে দিলাম। এখন তো সেটা সরকারিকরণের তালিকায়। শুনছি ওরাও নাকি ক্যাডার মর্যাদা পাবে।" আমি মজা করে বললাম, "দাদা, আপনি হলেন রাজনীতির ক্যাডার, আর বউ হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডার- সবাই ক্যাডার- হা-হা-হা।" 

পরীক্ষা না দিয়ে মোবাইল  টাওয়ার কিংবা এটিএম বুথের গার্ড হওয়া এ দেশে না গেলেও, শিক্ষা ক্যাডার হওয়া যায়। কারও দৃষ্টি এদিকে নেই।

যাহোক, কিছুদিন পর, সেই নগরকান্দার ইংরেজি স্যারের ফোন পেয়েছিলাম। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ওনি আমাকে জানালেন," স্যার, আমাদের কলেজ তো সরকারি হয়ে গেছে। আমরাও এখন লিখব- বিসিএস সাধারণ শিক্ষা। আচ্ছা স্যার, সত্যায়িত করার একটা সিল বানাতে কত খরচ পড়বে? ইংরেজিতে বানাবো নাকি বাংলায়?" আমি নির্বাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। শুধু বললাম, "আপনারা সত্যিই লাকি গো!"

এতক্ষণ আলোচনা শোনার পর আশাকরি বিজ্ঞ পাঠক বুঝতে পেরেছেন- "এই দেশে বিসিএস জিনিসটা কী? আর ক্যাডারই বা কী ?"

ক্যাডার হওয়ার এমন সস্তা ও জনপ্রিয় পথ পৃথিবীর আর কোথাও কি আছে ?

ওয়াদুদ খান 
কবি ও কথাশিল্পী 
সদরপুর, ফরিদপুর 
১৭ নভেম্বর, ২০১৭  
Share:

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

Recent Posts